ঠিক সেই ঘোর অন্ধকারে, মক্কার এক সাধারণ পরিবারে জন্ম নিলেন এক শিশু—মুহাম্মদ (সাঃ)। তাঁর শৈশব ছিল সরলতা ও সংগ্রামের। ছোটবেলা থেকেই তিনি ছিলেন তাঁর সমাজের থেকে আলাদা। তিনি ছিলেন শান্ত, চিন্তাশীল এবং চরম বিশ্বাসী (আল-আমিন) ও সত্যবাদী (আস-সাদিক)।
নবুয়ত ও জাগরণ
৪০ বছর বয়সে, মক্কার হেরা গুহায় তাঁর জীবনে এক অভাবনীয় মোড় আসে। তিনি পান আল্লাহর বাণী। এই বাণী তাঁকে শিখিয়েছিল একত্ববাদ (তাওহীদ), ন্যায়বিচার, সমানাধিকার এবং নৈতিকতা।
এই মুহূর্তটিই মানবজাতির ইতিহাসের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। শুরু হয় 'আল-আমিন'-এর মহাযাত্রা—অন্ধকার আর মিথ্যার বেড়াজাল ভেঙে সত্যের আলো ছড়িয়ে দেওয়ার যাত্রা। তাঁর প্রতিটি পদক্ষেপ ছিল সংস্কারের, তাঁর প্রতিটি কথা ছিল শান্তির।
তিনি গরিবকে দিলেন সম্মান।
তিনি নারীকে দিলেন অধিকার।
তিনি দাসকে দিলেন মুক্তি ও মর্যাদা।
তিনি শত্রুদের দিলেন ক্ষমা।
মদিনা হিজরত: এক নতুন যুগের সূচনা
হিজরত বলতে মূলত হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর ৬২২ খ্রিষ্টাব্দে মক্কা থেকে মদিনায় (তৎকালীন ইয়াসরিব) চলে যাওয়াকে বোঝায়।
১. হিজরতের পটভূমি (মক্কার অসহনীয় পরিস্থিতি)
নবুয়ত প্রাপ্তির পর প্রায় ১৩ বছর হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) মক্কায় ইসলাম প্রচার করেন। এই সময়ে:
অত্যাচার ও নির্যাতন: মক্কার কুরাইশরা ইসলাম গ্রহণকারী সাহাবিদের ওপর অমানুষিক অত্যাচার করত। অনেককে শহীদ করা হয়, আবার অনেকে حبشة (আবিসিনিয়া)-তে হিজরত করেন।
প্রচারণায় বাধা: কুরাইশরা নবিজি (সাঃ)-কেও শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতন করত এবং তাঁকে ইসলাম প্রচারে বাধা দিত।
ষড়যন্ত্র: অবস্থা এমন দাঁড়ায় যে কুরাইশরা শেষ পর্যন্ত তাঁকে হত্যা করার ষড়যন্ত্র করে। আল্লাহ্র নির্দেশে এবং এই চরম পরিস্থিতিতেই তিনি মক্কা ত্যাগের সিদ্ধান্ত নেন।
২. মদিনার আমন্ত্রণ (আকাবার বাইয়াত)
মক্কা থেকে মদিনায় চলে যাওয়ার কারণ হলো মদিনাবাসীদের আমন্ত্রণ:
নবিজি (সাঃ)-এর দাওয়াতের ফলে মদিনার কিছু সংখ্যক মানুষ ইসলাম গ্রহণ করেন। তাদের মধ্যে মদিনার প্রধান দুটি গোত্র - আউস এবং খাজরাজ-এর মানুষজনও ছিলেন।
তারা গোপনে মক্কার কাছে আকাবার নামক স্থানে নবিজি (সাঃ)-এর সাথে দেখা করে এবং তাঁকে মদিনায় আসার জন্য আমন্ত্রণ জানান। এটিকে আকাবার বাইয়াত বলা হয়। তারা কথা দেন যে তারা তাঁকে এবং মুসলিমদের পূর্ণ নিরাপত্তা দেবেন।
৩. হিজরতের ঘটনা
৬২২ খ্রিষ্টাব্দে আল্লাহর নির্দেশে নবিজি (সাঃ) হিজরত শুরু করেন:
তিনি গভীর রাতে মক্কা ত্যাগ করেন, তখন কুরাইশরা তাঁর ঘর ঘেরাও করে রেখেছিল। তাঁর সাথে ছিলেন বিশ্বস্ত সঙ্গী হযরত আবু বকর (রাঃ)।
তাঁরা মক্কার বাইরে সাওর গুহায় তিন দিন লুকিয়ে থাকেন। এই সময় কুরাইশরা মরিয়া হয়ে তাঁদের খুঁজছিল।
এরপর তাঁরা মদিনার দিকে যাত্রা করেন। পথে অনেক বিপদ ও প্রতিকূলতা পেরিয়ে অবশেষে তাঁরা মদিনার উপকণ্ঠে কুবা নামক স্থানে পৌঁছান।
৪. হিজরতের তাৎপর্য
মদিনায় পৌঁছার পর নবিজি (সাঃ) ও ইসলামের জন্য এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়:
ইসলামী রাষ্ট্রের ভিত্তি: মদিনায় তিনি একটি সুসংগঠিত ইসলামী রাষ্ট্র ও সমাজ প্রতিষ্ঠা করেন।
হিজরি সনের প্রবর্তন: এই হিজরতের দিনটিকে ভিত্তি করেই মুসলমানদের হিজরি বর্ষপঞ্জি গণনা শুরু হয়।
ভ্রাতৃত্ব বন্ধন (আখওয়াত): তিনি মক্কা থেকে আসা মুহাজির (অভিবাসী) এবং মদিনার আনসারদের (সাহায্যকারী) মধ্যে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন (আখওয়াত) স্থাপন করে দেন। এই বন্ধনের মাধ্যমে মুহাজিররা তাদের নতুন জীবনে সহজে মানিয়ে নিতে পারে।
মদিনা সনদ: তিনি মদিনার সকল গোত্র (মুসলিম ও অমুসলিম) এর জন্য মদিনা সনদ নামে একটি সংবিধান প্রণয়ন করেন, যা পৃথিবীতে ধর্মীয় সহাবস্থান ও নাগরিক অধিকারের এক অনন্য দলিল।
মক্কা বিজয়: এক শান্তিপূর্ণ বিপ্লব
মক্কা বিজয়ের মূল কারণ ছিল মক্কার কুরাইশদের চুক্তি ভঙ্গ। ৬২৮ খ্রিষ্টাব্দে মুসলিম ও কুরাইশদের মধ্যে যে হুদায়বিয়ার সন্ধি হয়েছিল, তাতে বলা হয়েছিল যে উভয়পক্ষ একে অপরের মিত্র গোত্রগুলোর সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হবে না।
কিন্তু কুরাইশদের মিত্র বনু বকর গোত্র হঠাৎ করে মুসলিমদের মিত্র বনু খুজাআ গোত্রের ওপর হামলা চালায়।
কুরাইশরা বনু বকরকে অস্ত্র ও লোকবল দিয়ে সাহায্য করে, যার মাধ্যমে তারা সরাসরি হুদায়বিয়ার সন্ধি ভঙ্গ করে।
বনু খুজাআ গোত্র সাহায্যের জন্য মদিনায় হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর কাছে লোক পাঠায়।
২. সামরিক প্রস্তুতি ও গোপনীয়তা
কুরাইশদের চুক্তি ভঙ্গের পর, হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) মক্কার বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনার সিদ্ধান্ত নেন।
তিনি প্রায় দশ হাজার সাহাবিকে নিয়ে মক্কার দিকে যাত্রা করেন। ইতিহাসে এত বড় সামরিক সমাবেশ মুসলিমদের এর আগে হয়নি।
অভিযানের গোপনীয়তা বজায় রাখতে তিনি কঠোর ব্যবস্থা নেন। উদ্দেশ্য ছিল কুরাইশদের কোনো রক্তপাত ঘটানোর সুযোগ না দিয়ে মক্কা দখল করা।
৩. শান্তিপূর্ণ প্রবেশ
মুসলিম বাহিনী মক্কার উপকণ্ঠে পৌঁছালে কুরাইশদের নেতা আবু সুফিয়ান মুসলিম বাহিনীর বিশালতা দেখে ভীত হন এবং ইসলাম গ্রহণ করেন।
হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) আবু সুফিয়ানকে এই ঘোষণা দিতে বলেন যে, "যারা নিজ নিজ ঘরে আশ্রয় নেবে, যারা কাবা ঘরে আশ্রয় নেবে এবং যারা আবু সুফিয়ানের ঘরে আশ্রয় নেবে, তারা নিরাপদ।"
এই ঘোষণার ফলে মক্কার অধিকাংশ মানুষ প্রতিরোধের পথ ছেড়ে দেয় এবং রক্তপাত ছাড়াই মুসলিম বাহিনী মক্কায় প্রবেশ করে। এটি ছিল ইসলামের ইতিহাসের এক বিরল ঘটনা, যেখানে একটি নগরী প্রায় বিনা যুদ্ধে বিজিত হয়েছিল।
৪. মূর্তি অপসারণ ও ক্ষমার ঘোষণা
মক্কা বিজয়ের পর হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) যে কাজগুলো করেন, তা তাঁর মহানুভবতা ও ইসলামের শান্তির বার্তা তুলে ধরে:
মূর্তি অপসারণ: তিনি কাবা ঘরে রক্ষিত ৩৬০টি মূর্তি নিজ হাতে ভেঙে ফেলেন এবং ঘোষণা করেন: "সত্য এসেছে এবং মিথ্যা বিলুপ্ত হয়েছে।" এর মাধ্যমে আরবে তাওহীদ (একত্ববাদ) আবার প্রতিষ্ঠিত হয়।
সাধারণ ক্ষমা: তিনি মক্কাবাসীর উদ্দেশে এক ঐতিহাসিক ভাষণ দেন। যাদের অত্যাচারে তাঁকে ও তাঁর সাহাবিদের মক্কা ছেড়ে যেতে হয়েছিল, সেই শত্রুদের তিনি সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেন। তিনি বলেন, "আজ তোমাদের উপর কোনো প্রতিশোধ নেই, যাও তোমরা সবাই মুক্ত।"
তাঁর এই ক্ষমা ছিল উদারতা ও সহিষ্ণুতার এক অনন্য উদাহরণ, যা তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করে।
নবিজির বিদায় হজ ও ঐতিহাসিক ভাষণ
হিজরি দশম সনে (৬৩২ খ্রিষ্টাব্দে), হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) তাঁর জীবনের শেষ হজ পালন করেন। এই হজে তিনি যে ভাষণ দিয়েছিলেন, তা বিদায় হজের ভাষণ নামে পরিচিত এবং এটি মানবজাতির ইতিহাসে মানবাধিকারের এক মহান দলিল।
১. বিদায় হজের উদ্দেশ্য ও প্রেক্ষাপট
উপস্থিতি: এই হজে লক্ষাধিক সাহাবি তাঁর সাথে ছিলেন। এটি ছিল মুসলিমদের সবচেয়ে বড় সমাবেশগুলোর মধ্যে অন্যতম।
সময়: এই হজ ছিল তাঁর জীবনের শেষ হজ। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন যে, এটিই তাঁর সাথে উম্মতের শেষ আনুষ্ঠানিক সাক্ষাৎ। তাই তিনি তাঁর নবুয়তের ২৩ বছরের সকল মূল শিক্ষা এই ভাষণে সংক্ষিপ্ত আকারে পেশ করেন।
২. ভাষণের স্থান
ভাষণটি মূলত তিনটি স্থানে দেওয়া হয়েছিল, তবে এর মূল ও সর্বাধিক পরিচিত অংশটি আরাফাতের ময়দানে, জাবালে রাহমাত (রহমতের পর্বত)-এর পাদদেশে দাঁড়িয়ে দেওয়া হয়।
৩. ভাষণের মূল বার্তা (মানবতার দলিল)
বিদায় হজের ভাষণে নবিজি (সাঃ) এমন কিছু মৌলিক নীতি ঘোষণা করেন যা আজও আধুনিক বিশ্বের মানবাধিকারের ভিত্তি হিসেবে বিবেচিত হয়:
১. রক্তপাত ও প্রতিশোধের বিলুপ্তি:
তিনি অতীত জাহেলিয়াত (অন্ধকারের যুগ)-এর সকল রক্তপাতকে বাতিল ঘোষণা করেন।
তিনি ঘোষণা করেন যে, একজন মানুষের জীবন অন্য মানুষের জন্য পবিত্র।
তিনি সুদের প্রথা চিরতরে নিষিদ্ধ করেন।
২. আমানত ও অধিকার:
তিনি স্পষ্ট করে দেন যে, সকলের সম্পত্তি ও সম্মান একে অপরের কাছে পবিত্র।
তিনি বলেন, আমানত যার, তাকে ফিরিয়ে দিতে হবে।
৩. নারীর অধিকার ও মর্যাদা:
তিনি বিশেষভাবে নারীদের অধিকারের প্রতি যত্নশীল হতে নির্দেশ দেন।
তিনি বলেন, নারীদের ওপর পুরুষদের যেমন অধিকার আছে, তেমনি পুরুষদের ওপরও নারীদের অধিকার আছে। তিনি উম্মতকে নারীদের সাথে উত্তম ব্যবহার করার অঙ্গীকার নিতে বলেন।
৪. জাতিগত সমতা (বর্ণবৈষম্য দূরীকরণ):
তিনি ঘোষণা করেন, "কোনো আরব অনারবের উপর শ্রেষ্ঠ নয়, আবার কোনো অনারব আরবের উপর শ্রেষ্ঠ নয়। সাদা মানুষ কালো মানুষের উপর শ্রেষ্ঠ নয়, আবার কালো মানুষ সাদা মানুষের উপর শ্রেষ্ঠ নয়। শ্রেষ্ঠত্ব কেবল তাকওয়ার ভিত্তিতে।"
এটি ছিল বর্ণবাদ ও জাতিগত শ্রেষ্ঠত্বের ধারণার বিরুদ্ধে সবচেয়ে শক্তিশালী ঘোষণা।
৫. চূড়ান্ত ঐশী বার্তা:
ভাষণের এক পর্যায়ে তিনি বলেন, "আমি তোমাদের মাঝে দুটি জিনিস রেখে গেলাম, তোমরা যদি তা দৃঢ়ভাবে ধরে রাখো, তবে কখনও পথভ্রষ্ট হবে না—আল্লাহর কিতাব (কোরআন) ও আমার সুন্নাহ (হাদিস)।"
৬. রিসালাতের সাক্ষ্য:
ভাষণের শেষে তিনি জনতার কাছে জানতে চান, "আমি কি তোমাদের কাছে (আল্লাহর) বার্তা পৌঁছে দিয়েছি?" জনতা সমস্বরে জবাব দেয়, "হ্যাঁ! আপনি পৌঁছে দিয়েছেন।" তখন তিনি আকাশের দিকে মুখ করে বলেন, "হে আল্লাহ! তুমি সাক্ষী থাকো।"
Comments
Post a Comment